সেলিনা হোসেন (জন্ম জুন ১৪, ১৯৪৭) বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত মহিলা ঔপন্যাসিক । সেলিনা হোসেনের জন্ম রাজশাহী শহরে। তাঁর পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজিরপাড়া গ্রাম। বাবা এ কে মোশাররফ হোসেন এবং মা মরিয়মন্নেসা বকুল। তিনি পিতা মাতার চতুর্থ সন্তান। বাবা এ কে মুশাররফ হোসেন এর আদিবাড়ি নোয়াখালি হলেও চাকরিসূত্রে বগুড়া ও পরে রাজশাহী থেকেছেন দীর্ঘকাল; কাজেই সেলিনাকে একেবারে মেয়েবেলায় নোয়াখালিতে বেশিদিন থাকতে হয়নি। সেলিনা হোসেনের মায়ের নাম মরিয়ামুন্ননেছা বকুল। মুশাররফ-মরিয়ামুন্ননেছা দম্পতির সব মিলিয়ে সাত ছেলেমেয়ে। সেলিনা ভাইবোনদের মধ্যে চতুর্থ। মহান ভাষা আন্দোলনের দুবছর পর পর (অর্থাৎ,১৯৫৪ সালে) বগুরার লতিফপুর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হল বালিকা সেলিনা। ক্লাস থ্রিতে। কেননা, ক্লাস ওয়ান আর টু-র পড়া শেখা হয়েছিল বাড়িতে বসেই। সে কালে সে রকমই হত। যা হোক প্রাইমারি শিক্ষা ওই লতিফপুর স্কুলেই শেষ হল। তিনি প্রায়ই ক্লাসে এসে আবৃত্তি করতেন-
পাখি সব করে রব রাত্রি পোহাইল; কাননে কুসুমকলি সকলই ফুটিল।
পদ্য আবৃত্তি শেষ করে তারপর শিক্ষকটি বলতেন, সোনামনিরা, তোমরা সবাই কুসুমকলি । তোমরা সবাই একদিন ফুলের মতন ফুটবে, দেখ। এই কথাটাই বালিকা সেলিনার মনে ভীষণ দাগ কেটেছিল। পরবর্তী জীবনে যতই আপদবিপদ এসেছিল-ওই লতিফপুর স্কুলের পঙ্গু শিক্ষকটি এসে যেন ফিসফিস করে বলতেন,শক্ত হ মা। হার মানিস নে। তোর এক মেয়ে মরেছে তো কি। তোর মেয়ে কি একটা! বালিকা সেলিনার কী সৌভাগ্য যে- অমন একটা স্কুলের মহৎ হৃদয়ের শিক্ষকদের সান্নিধ্যে প্রাথমিক লেখাপড়া শিখেছিলেন! দু’বছর পর। ১৯৫৭। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলেন ভি এম গালর্স স্কুলে। নতুন স্কুল; নতুন জীবন। হেডমিসট্রেস ছিলেন সালেহা খাতুনের ছিল চন্ড রাগ। বড় বদরাগী ছিলেন ওই মহিলা; সারাক্ষণ জ্বালিয়ে মারতেন। যা হোক। বেশি দিন ওই পচা স্কুলে থাকতে হয়নি বালিকার। বাবা বদলী হয়ে এলেন রাজশাহী । দু’বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে রাজশাহীর নাথ গালর্স স্কুলে ক্লাস এইটে ভরতি হল কিশোরী সেলিনা। নাথ গালর্স স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষক-শিক্ষকাই ছিলেন উদার আর মহৎ। কেননা, ছাত্রীদের তারা কেবল সিলেবাসে আটকে রাখেননি। সিলেবাসের বাইরে কতকিছু যে কথা বলতেন তারা। কিশোরী সেলিনার ছিল উৎসুক মন। ভালো লাগত জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা শুনতে; ভালো লাগত ভাষা, বাংলা ও ইংরেজি ভাষা। ভালো লাগত অক্ষর, শব্দ। ভালো লাগত লিখতে। টুকটাক মনের কথা লিখতে। কবিতা পড়তে। তখনই একদিন প্রথম জীবনানন্দের কবিতা পড়ে অবশ বোধ করেছিল কিশোরী। রজদর্শনের মত দিনটাকে কখনও ভোলা গেল না। তারপর জীবনটা আর আগের মতো থাকেনি কিশোরীর। ধানসিঁড়ি নদীটি কোথায়? ওই নদীর ওপর মেঘ জমে, সোনালি ডানার চিল ওড়ে? হায়, চিল সোনালি ডানার চিল, তুমি আর ঘুরে ঘুরে উড়ো নাকো ধানসিঁড়ি ...ধানসিঁড়ি নদীটি কোথায়? বুকের ভিতর কী এক আবেগ তখন থরথর করে কাঁপত। মাঝরাতের অন্ধকারে শুয়ে শোনা যেত পদ্মার পাড় ভাঙ্গর শব্দ। অন্ধকারে কে যেন তখন ফিসফিস করে বলত-
পাখি সব করে রব রাত্রি পোহাইল কাননে কুসুমকলি সকলই ফুটিল।
সারারাত দুচোখে ঘুম আসত না। আমি কে? আমি এখানে কেন? আমি ঘুমাতে পারি না কেন? ভোরে দূরর হেতেম খাঁ মসজিদের মুয়াজ্জিনের আজান শোনা যেত। চোখে জলে ভরে যেন কবি কিশোরীর। ধানসিঁড়ি নদীটি কোথায়? এই প্রশ্নটাই জীবনভর তাড়িয়ে বেড়াবে।ধানসিঁড়ি নদীটি কোথায়? জীবনানন্দ কে? কবি কে? শব্দ কি? সেই কিশোরী দিনগুলোয় কী এক ব্যাথা বাজত বুকে। ওই নাথ গালর্স স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক (তখন এস এস সি বলা হত না) পাশ করল কিশোরী সেলিনা ১৯৬২ সালে। ১৯৬২ সালে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হলেন ঠিকই কিন্তু তখন শরীর এমনই কাহিল যে ক্লাস করা হল না। আহা তখন কী যন্ত্রনাই না সময় কেটেছিল কিশোরী সেলিনার। শিক্ষকটি এসে যেন ফিসফিস করে বলতেন,শক্ত হ মা। হার মানিস নে। রাজশাহী উইমেন্স কলেজে ভর্তি হল সেলিনা। মজা এই- সেলিনারাই ছিল ওই কলেজের প্রথম ব্যাচ। শরীরে যন্ত্রণা তো কি-সারাদিন দাপাদাপি করে বেড়াত তরুণী সেলিনা। ক্লাসমেটদের মধ্যে উজ্জ্বলতম বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। এত কথা বলত! কবি তো। তাই। ১৯৬৪। রাজশাহীতে আর্ন্তকলেজ প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠিত হবে। সব মিলিয়ে সাতটি ইভেন্টে নাম লেখাল সেলিনা। প্রথম হল ছটিতে-একটি ইভেন্টে হল তৃতীয়। তখন বলছিলাম না- সেলিনা ছিল রাজশাহী উইমেন্স কলেজের সবচে উজ্জ্বলতম বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। এই মেয়েই তো একদিন বাংলায় উপন্যাস লিখে দু-বাংলার বোদ্ধা মহলে ঝড় তুলবে। লিখবে “গায়ত্রী সন্ধ্যা”র বিপুলায়তন উপন্যাস। কলেজ জীবন শেষ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে ভর্তি হল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার জীবনে যুক্ত হল নিবিড় সাংস্কৃতিক ও গভীর রাজনৈতিক অধ্যায়। ১৯৬৭ সালে বিতর্ক প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পাঞ্জাব যাওয়ার কথা থাকলেও অস্থির রাজনৈতিক অবস্থার কারণে যাওয়া হয়নি। এই আক্ষেপ আজও কাঁটার মত বেঁধে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বি এ অনার্স পাশ করলেন ১৯৬৭ সালে। এম এ পাশ করলেন পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে।
রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে বড় ভালো লাগে সেলিনার; লোকগানের মধ্যে ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া। যন্ত্রসঙ্গীতের মধ্যে বাঁশী ও শানাই।
সেলিনা হোসেন বাংলা একাডেমিকে যোগ দেন ১৯৭০। আজও ওখানেই আছেন।
কর্মজীবন
ষাটের দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী বিশ্বমিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তাঁর লেখালেখির সূচনা। প্রথম গল্পগ্রন্থ উৎস থেকে নিরন্তর প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। ভ্রমণ তাঁর নেশা। তাঁর মোট উপন্যাসের সংখ্যা ২১টি, গল্প গ্রন্থ ৭টি এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ৪টি।
গ্রন্থতালিকা
উপন্যাস
* কাঠকয়লার ছবি
* ঘুমকাতুরে ঈশ্বর
* লারা
পুরষ্কার
* ড: মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক (১৯৬৯)
* বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৮০)
* আলাওল সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৮১)
* কামার মুশতারি স্মৃতি পুরষ্কার (১৯৮৭)
* ফিলিপস্ সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৯৪)
* অলক্তা সাহিত্য পুরষ্কার (১৯৯৪)
* রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার (2010)
No comments:
Post a Comment